বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্রে কি কি যন্ত্রপাতি থাকে?

ভূমিকা:

উপকেন্দ্র বৈদ্যুতিক পাওয়ার সিস্টেমের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যা ভোল্টেজের রূপান্তর করে, বিদুৎ বিতরণ করে এবং বৈদ্যুতিক সিস্টেমের স্থিতিশীলতা রাখে। কাজের ধরনের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের উপকেন্দ্র রয়েছে, যেমন: স্টেপ অপ উপকেন্দ্র, স্টেপ ডাউন উপকেন্দ্র, বিতরণ উপকেন্দ্র ইত্যাদি।

এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্রের প্রধান অংশসমূহ এবং তাদের কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।

উপকেন্দ্রের অংশসমূহ:

১. পাওয়ার ট্রান্সফরমার:

চাহিদা অনুযায়ী ভোল্টেজকে নিম্ন লেভেল হতে উচ্চ লেভেল বা উচ্চ লেভেল হতে নিম্ন লেভেলে রূপান্তরের জন্য ট্রান্সফরমার ব্যবহার করা হয়। সাধারণত উৎপাদন প্রান্তের উৎপাদিত নিম্ন ভোল্টেজকে সঞ্চালনের জন্য স্টেপ অপ ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে উচ্চ ভোল্টেজে রূপান্তর করা হয় এবং বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র হতে গ্রাহক প্রান্তে নিম্ন ভোল্টেজ সরবরাহের জন্য স্টেপ ডাউন ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে উচ্চ ভোল্টেজকে নিম্ন ভোল্টেজে রূপান্তর করা হয়।

২. বাস বার:

1000114906
“Bus bars and inductive filters at substation near Denver International Airport, Colorado, 2006” by Greg Goebel is licensed under CC BY-SA 2.0

সাধারনত উচ্চ পরিবাহিতা সম্পন্ন তামা বা অ্যালুমিনিয়ামের বার বা তার দিয়ে বাসবার তৈরি করা হয় যার মাধ্যমে ইনকামিং লাইন হতে উপকেন্দ্রে পাওয়ার গৃহীত হয় এবং আউটগোয়িং লাইনের মাধ্যমে পাওয়ার বিতরণ করা হয়।

৩. সার্কিট ব্রেকার:

সাভাবিক অবস্থায় বা ফল্ট এর সময় সয়ংক্রিয় ভাবে বা ম্যানুয়ালি বৈদ্যুতিক সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করার জন্য জন্য সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করা হয়। সার্কিট ব্রেকার বৈদ্যুতিক সিস্টেমের নিরাপত্তার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান যা স্থাপনা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এবং ব্যক্তিবর্গকে সম্ভাব্য ক্ষতির হতে সুরক্ষা প্রদান করে।

৪. আইসোলেটর:

RNDZ 1 110

“Isolator”
 by Buryka is licensed under CC BY-SA 3.0

উপকেন্দ্রের কোনো অংশকে বিদুৎ হতে পরিপূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করার জন্য আইসলেটর ব্যবহার করা হয়। আইসোলটরে কোনো আর্ক নির্বাপক ব্যবস্থা থাকে না ফলে আইসোলেটর শুধুমাত্র নো লোড বা হালকা লোডে পরিচালনা করা হয়।

৫. রিলে:

তাৎক্ষণিক বৈদ্যুতিক ফল্ট নির্ণয় এবং সার্কিট ব্রেকারকে পরিচালিত হওয়ার সংকেত প্রদানের জন্য রিলে ব্যবহার করা হয়। রিলে হতে সংকেত পেলেই সার্কিট ব্রেকার সয়ংক্রিয়ভাবে খুলে (Open) যায়। রিলেকে উপকেন্দ্রের মস্তিষ্ক বলা হয়। বিভিন্ন ধরনের রিলে রয়েছে, যেমন: ওভার কারেন্ট রিলে, ডিফারেনশিয়াল রিলে, ডিসটেন্স রিলে ইত্যাদি।

৬. ইন্সট্রুমেন্ট ট্রান্সফরমার:

বৈদ্যুতিক কারেন্ট এবং ভোল্টেজকে সহজে পরিমাপের জন্য ইন্সট্রুমেন্ট ট্রান্সফরমার এর মাধ্যমে নিরাপদে পরিমাপযোগ্য মানে রূপান্তর করা হয়। দুই ধরনের ইন্সট্রুমেন্ট ট্রান্সফরমার রয়েছে:

  • ১. কারেন্ট ট্রান্সফরমার (CT):উচ্চ কারেন্টকে পরিমাপযোগ্য নিম্ন মানে রূপান্তরের জন্য কারেন্ট ট্রান্সফরমার ব্যবহার করা হয়।
  • ২. পোটেনশিয়াল ট্রান্সফরমার (PT):উচ্চ ভোল্টেজকে পরিমাপযোগ্য এবং নিরাপদ মানে রূপান্তরের জন্য পোটেনশিয়াল ট্রান্সফরমার ব্যবহার করা হয়।

৭. লাইটনিং অ্যারেস্টার:

উপকেন্দ্রের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিকে বজ্রপাতের আক্রমন হতে রক্ষার জন্য লাইটনিং অ্যারেস্টার ব্যবহার করা হয়। বজ্রপাতের ফলে সৃষ্ট অতি উচ্চ সার্জ ভোল্টেজেকে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিতে প্রবেশ করতে না দিয়ে লাইটনিং অ্যারেস্টার এর মাধ্যমে নিরাপদে ভূমিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

৮. সার্জ ডাইভার্টার:

উপকেন্দ্রের যন্ত্রপাতিকে ফল্ট এর কারণে সৃষ্ট সার্জ ভোল্টেজের হাত থেকে রক্ষার জন্য সার্জ ডাইভার্টার ব্যবহার করা হয়।

৯. ক্যাপাসিটির ব্যাংক এবং রিয়্যাক্টর:

উপকেন্দ্রের ভোল্টেজ নিয়ন্ত্রণ এবং পাওয়ার ফ্যাক্টর উন্নয়নের জন্য ক্যাপাসিটির ব্যাংক এবং রিয়্যাক্টর ব্যবহার করা হয়।

১০. গ্রাউন্ডিং সিস্টেম:

ফল্ট এর সময় ফল্ট কারেণ্ট প্রবাহের নিরাপদ পথ প্রদান করা জন্য গ্রাউন্ডিং সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। এতে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি উচ্চ ফল্ট কারেন্ট প্রবাহের এর ক্ষতি হতে সুরক্ষিত থাকে।

১১. অক্সিলিয়ারি পাওয়ার সাপ্লাই:

বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্রের নিজস্ব ব্যবহার অক্সিলিয়ারি পাওয়ার সাপ্লাই। উপকেন্দ্রে এক বা একাধিক অক্সিলিয়ারি ট্রান্সফরমার থাকে যার মাধ্যমে শুধুমাত্র উপকেন্দ্রের নিজস্ব লোড যেমন বাতি, ফ্যান, শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র এবং উপকেন্দ্রের অন্যান্য সকল যন্ত্রপাতিতে সরবরাহ প্রদান করা হয়।

১২. ডিসি সিস্টেম:

ব্ল্যাকআউট এর সময় উপকেন্দ্রের উপকেন্দ্রকে আলোকিত করতে এবং গুরুত্বপুর্ন যন্ত্রপাতিতে বিদুৎ সরবরাহ করতে ডিসি সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। এছাড়া উপকেন্দ্রের রিলে সমূহ ডিসি পাওয়ার ব্যবহার করে।

১৩. যোগাযোগের যন্ত্রপাতি:

যোগাযোগ রক্ষা এবং তথ্য আদান প্রদানের জন্য উপকেন্দ্রে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি যেমন ওয়াকিটকি, ওয়ারলেস রেডিও, ফাইবার অপটিক সিস্টেম ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়।

১৪. কন্ট্রোল রুম:

PSX 20241219 001302
Control room of an electrical substation at Dhaka, Bangladesh

উপকেন্দ্রের কন্ট্রোলরুমে এক বা একাধিক মনিটর, কন্ট্রোল প্যানেল এবং নিরাপত্তা সিস্টেম এর নিয়ন্ত্রণ থাকে। কন্ট্রোল রুম হতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ নিরাপদে উপকেন্দ্র সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করেন।

১৫. অগ্নি নির্বাপন সিস্টেম:

উপকেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ড জনিত দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরনের অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।

উপসংহার:

একটি বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্রের বিভিন্ন অংশ একত্রে কাজ করে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সঞ্চালন, রূপান্তর এবং বিতরণ নিশ্চিত করে। এই উপাদানগুলির সঠিক ডিজাইন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনা বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দক্ষতা এবং নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দুই দেশের মধ্যে বিদুৎ আমদানি বা রপ্তানির জন্য HVDC ব্যবহার করা হয় কেন?

ভূমিকা:

দুটি ভিন্ন দেশের মধ্যে বৈদ্যুতিক পাওয়ার সরবরাহের ক্ষেত্রে উচ্চ ভোল্টেজ ডাইরেক্ট কারেন্ট (High Voltage Direct Current) বা HVDC একটি বহুল ব্যবহৃত প্রযুক্তি। নির্ভরযোগ্যতা, দক্ষতা এবং বিভিন্ন ধরনের গ্রিড নেটওয়ার্ককে যুক্ত করার ক্ষমতা HVDC প্রযুক্তির অন্যতম সুবিধা। দীর্ঘ দুরত্বে বেশি পরিমানে বিদুৎ সঞ্চালন এবং দুটি এসিংক্রোনাস (Asynchronous) গ্রিডকে যুক্ত করার কাজে HVAC এর তুলনায় HVDC অধিক উপযোগী এবং সুবিধাজনক।

এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা ক্রস বর্ডার পাওয়ার সঞ্চালনের ক্ষেত্রে HVDC প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।

HVDC ব্যবহারের কারণ:

১. এসিংক্রোনাস (Asynchronous) গ্রিডের মধ্যে অন্তসংযোগ:
যখন দুটি গ্রিডে আলাদা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করা হয় তখন তাদের এসিংক্রোনাস গ্রিড বলে। ক্রস বর্ডার পাওয়ার সঞ্চালনের ক্ষেত্রে HVDC ব্যবহারের অন্যতম কারণ হলো দুটি ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির গ্রিডের মধ্যে আন্তসংযোগ তৈরি করা।

কারণ:

  • HVDC প্রযুক্তিতে HVAC এর মত গ্রিডের অন্তসংযোগের জন্য ফ্রিকোয়েন্সি একই হওয়ার প্রয়জন হয় না।
  • ফলে দুটি দেশ বা গ্রিডের ফ্রিকোয়েন্সি আলাদা হলেও তারা একে অপরের সাথে বৈদ্যুতিক পাওয়ার বিনিময় করতে পারে।

উদাহরণ:
জাপানের ৫০ হার্জ এবং ৬০ হার্জ গ্রিড নেটওয়ার্কের মধ্যকার অন্তঃসংযোগ HVDC প্রযুক্তির ব্যবহারের অন্যতম উধাহরন।

২. গ্রিডের স্থিতিশীলতা এবং ফল্ট আইসোলেসন (Grid Stability and Fault Isolation):
HVDC লিঙ্ক গ্রিডের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে এবং অন্তসংযুক্ত গ্রিডকে একে অপরের ফল্ট এর প্রভাব থেকে পৃথক (Isolate) রাখে। ফলে আন্তসংযুক্ত গ্রিডের কোনো একটিতে ফল্ট সংগঠিত হলে বাকি গ্রিড সমূহ ফল্ট এর প্রভাব থেকে সুরক্ষিত থাকে।

সুবিধা: HVDC লিঙ্ক একটি প্রতিরক্ষা দেয়াল হিসেবে কাজ করে ফল্ট কে বিস্তৃত হতে বাধা দেয়।
ফল্ট হতে তাৎক্ষণিক পৃথকীকরণ ( Isolation) এবং উদ্ধার (Recovery) এর কারণে ক্রস বর্ডার পাওয়ার সঞ্চালন সুনিশ্চিত হয়।

উদাহরণ:
ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে উভয় দেশের গ্রিডের ফ্রিকোয়েন্সি ৫০ হার্জ হওয়া সত্ত্বেও গ্রিডের স্ট্যাবিলিটি এবং ফল্ট আইসোলেশনের বিবেচনা করে ব্যাক টু ব্যাক HVDC লিঙ্ক ব্যবহার করা হয়েছে যাতে এক দেশের গ্রিডে ফল্ট সংগঠিত হলে অন্য দেশের গ্রিড ফল্টের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে।

৩. সঞ্চালন লস হ্রাস:
HVAC এর তুলনায় HVDC প্রযুক্তিতে বৈদ্যুতিক লসের পরিমাণ কম হয়।

কারণ

  • DC তে স্কিন ইফেক্ট এর প্রভাব না থাকায় পরিবাহীর কার্যকরী রোধের পরিমাণ কম থাকে। ফলে I2*R লস কম হয়।
  • DC সিস্টেমে রিয়্যাক্টিভ পাওয়ার না থাকায় লস হ্রাস পায় এবং গ্রাহক প্রান্তে স্থির ভোল্টেজ পাওয়া যায়।

সুবিদা:
লস হ্রাসের মাধ্যমে দীর্ঘ দুরত্বে পাওয়ার ট্রান্সমিশনের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।

৪. ব্যয় হ্রাস:
HVDC এর প্রাথমিক সংস্থাপন খরচ বেশি হলেও দীর্ঘ দুরত্বে বিশাল পরিমাণ পাওয়ার সরবরাহের ক্ষেত্রে HVDC প্রযুক্তি অধিক সাশ্রয়ী এবং মিতব্যয়ী। ওভারহেড ৬০০ কিলোমিটার বা ৫০ কিলোমিটার বা তারচেয়ে দীঘ্র সাবমেরিন ক্যাবলের সঞ্চালন লাইনের ক্ষেত্রে HVAC এর তুলনায় HVDC কম ব্যয়বহুল।

কারণ:

  • HVDC তে সঞ্চালন লস কম হওয়ায় সঞ্চালন ব্যয় কম হয়।
  • উচ্চ ভোল্টেজ এবং দীর্ঘ দুরত্বে পাওয়ার ট্রান্সমিশনের খেরে HVAC এর তুলনায় HVDC এর সুইচ গিয়ার এবং টার্মিনাল ইকুইপমেন্ট এর খরচ তুলনামুলক কম।
  • ভবিষ্যতে সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে HVAC এর তুলনায় HVDC বেশি সাশ্রয়ী।

সুবিদা:
দীর্ঘ মেয়াদে স্বল্প খরচে বিদুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হয়।

৫. পাওয়ার এর প্রবাহে অধিকতর নিয়ন্ত্রণ:
HVDC প্রযুক্তিতে কি পরিমান পাওয়ার প্রবাহিত হবে এবং কেন দিকে প্রবাহিত হবে তা অতি সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় যা ক্রস বর্ডার পাওয়ার ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সুবিদা:

  • কি পরিমান পাওয়ার ট্রান্সফার হবে তা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সিস্টেমকে ওভারলোড হতে রক্ষা করা যায়।
  • ফলে পরিবর্তনশীল লোডের ক্ষেত্রে গ্রিডের স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

৬. ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্টারফারেন্স এর প্রভাব হ্রাস:
HVAC এর তুলনায় HVDC ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্টারফারেন্স দ্বারা কম প্রভাবিত হয় ফলে এবং আশেপাশের পরিবেশকে কম প্রভাবিত করে।

উপসংহার:

ক্রস বর্ডার পাওয়ার ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে দক্ষতা, নিরপত্তা এবং এসিংক্রোনাস গ্রিডকে যুক্ত করার বিষয় বিবেচনায় HVDC প্রযুক্তি অত্যাবশ্যক। এটা দীর্ঘ দুরত্বে পাওয়ার ট্রান্সমিশনের ক্ষেত্রে লস হ্রাস করে, স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে এবং ফল্ট কে ছড়িয়ে পড়া হতে প্রতিহত করে যা একে আন্তর্জাতিক বিদুৎ বিনিময়ের ক্ষেত্রে সবচে ভালো বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

বিভিন্ন ধরনের থার্মোডাইনামিক সাইকেল এবং তাদের ব্যবহার

ভূমিকা:

বৈদ্যুতিক পাওয়ার উৎপাদনে থার্মোডাইনামিক সাইকেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কারণ পাওয়ার উৎপাদনে ব্যবহৃত থার্মোডাইনামিক সাইকেলই নির্ধারণ করে কিভাবে তাপীয় শক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর ঘটবে এবং রূপান্তরের দক্ষতা কেমন হবে। প্রতিটি থার্মোডাইনামিক সাইকেলের দক্ষতা, ব্যবহৃত জ্বালানির ধরন এবং অপারেটিং কন্ডিশন বিবেচনা করে একেক অবস্থায় একেক থার্মোডাইনামিক সাইকেল ব্যবহার করা হয়।

এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা বৈদ্যুতিক পাওয়ার উৎপাদনে ব্যবহৃত বিভিন্ন থার্মোডাইনামিক সাইকেল ও তাদের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।

থার্মোডাইনামিক সাইকেল (Thermodynamic Cycle):

থার্মোডাইনামিক সাইকেল হল এক ধরনের প্রক্রিয়া যেখানে একটি পদার্থ একাধিক ধাপ অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত আবার তার প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে আসে। এই প্রক্রিয়ায় তাপ এবং কাজের আদান-প্রদান হয়। সহজ কথায়, এটি একটি ঘূর্ণায়মান প্রক্রিয়া যেখানে একটি পদার্থ একই চক্রের ভিতর দিয়ে দিয়ে বারবার অতিক্রম করে। এই প্রক্রিয়াগুলিতে সিস্টেম তাপ শক্তি গ্রহণ বা সরবরাহ করে এবং তা যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে বা বিপরীতভাবে যান্ত্রিক শক্তিকে তাপ শক্তিতে রূপান্তর করে।

একটি থার্মোডাইনামিক সাইকেল সাধারণত চারটি ধাপের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়:
1. প্রসারণ (Expansion): তাপে সিস্টেম প্রসারিত হয়।
2. তাপ সরবরাহ (Heat Addition): সিস্টেমে বাহ্যিক তাপ সরবরাহ করা হয়।
3. সংকোচন (Compression): সিস্টেম সংকুচিত হয়।
4. তাপ অপসারণ (Heat Rejection): সিস্টেম থেকে তাপ অপসারণ করা হয়।

বিদুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত থার্মোডাইনামিক সাইকেল সমূহ:

১. র‍্যাঙ্কিন সাইকেল (Rankine Cycle):

বিদুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত থার্মোডাইনামিক সাইকেল হলো র‍্যাঙ্কিন সাইকেল।

কার্যপ্রণালী:


১. পানিকে উত্তপ্ত করে বাষ্প উৎপন্ন করা হয় এবং এই উৎপন্ন বাষ্পের মাধ্যমে টারবাইনকে ঘুরিয়ে যান্ত্রিক তাপ শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করা হয়।
২. এই সাইকেলটি চারটি প্রধান ধাপে সম্পন্ন হয়, যথা: ১. isobaric heat addition, ২. adiabatic expansion, ৩. isobaric heat rejection, এবং ৪. adiabatic compression.

ব্যবহার:
১. তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং
২. পারমাণবিক বিদুৎ কেন্দ্র।

সুবিধা:
১. আধুনিক প্রযুক্তি যেমন Reheating এবং Regenerative Feed Water Heating ব্যবহার করে উচ্চ দক্ষতা অর্জন করা যায়।

২. ব্রেইটন সাইকেল (Brayton Cycle):

ব্রেইটন সাইকেল সাধারনত গ্যাস টারবাইন বিদুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার করা হয়।

কার্যপ্রণালী:

১. বাতাসকে সংকুচিত করে জ্বালানির সাথে মিশ্রিত করা হয় এবং কম্বাসন চেম্বারের মধ্যে পোড়ানো হয়। ফলে এই উত্তপ্ত গ্যাস এর চাপ বৃদ্ধি পায় এবং এই উত্তপ্ত গ্যাসকে টারবাইনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করে টারবাইনকে ঘুরানো হয়।
২. এই সাইকেল চারটি প্রধান ধাপে সম্পন্ন হয়, যথা: ১. isobaric heat addition, ২. adiabatic compression, ৩. adiabatic expansion এবং ৪. isobaric heat rejection.

ব্যবহার:
১. গ্যাস টারবাইন বিদুৎ কেন্দ্র,
২. কম্বাইন্ড সাইকেল বিদুৎ কেন্দ্র,
৩. উড্ডয়ন শিল্প ইত্যাদি।

সুবিধা:
পিক লোডের জন্য দ্রুত স্ট্রাটঅপ সুবিধা পাওয়া যায়।

৩. কম্বাইন্ড সাইকেল (Combined Cycle):

সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে র‍্যাঙ্কিন সাইকেল এবং ব্রেইটন সাইকেল কে একত্রে ব্যবহার করা হয় যা কম্বাইন্ড সাইকেল নামে পরিচিত।

কার্যপ্রণালী:

ব্রেইটন সাইকেলের গ্যাস টারবাইন হতে নির্গত গ্যাসের তাপকে কাজে লাগিয়ে র‍্যাঙ্কিন সাইকেলের মাধ্যমে বাষ্প উৎপন্ন করে স্টিম টারবাইনকে ঘুরানো হয় এবং বিদুৎ উৎপাদন করা হয়।

ব্যবহার:
বর্তমানে বেশিভাগ আধুনিক বিদুৎ কেন্দ্রই কম্বাইন্ড সাইকেল ব্যবহার করে বিদুৎ উৎপাদন করা হয়। এতে বিদুৎ কেন্দ্রের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।

সুবিধা:
কম্বাইন্ড সাইকেল বিদুৎ কেন্দ্রের দক্ষতা র‍্যাঙ্কিন সাইকেল এবং ব্রেইটন সাইকেলের থেকে তুলনামুলক বেশি হয় এবং এটি ৬০% পর্যন্ত দক্ষতায় শক্তির রূপান্তর করতে পারে।

৪. কার্নো সাইকেল (Carnot Cycle):

কার্নো সাইকেল একটি তাত্ত্বিক মডেল যা তাপ ইঞ্জিনের সর্বচ্চো তাপীয় দক্ষতা নির্ণয়ে ব্যবহার করা হয়।

কার্যপ্রণালী:

১. দুটি isothermal processes এবং two adiabatic processes এর মাধ্যমে শক্তির রূপান্তর ঘটে।
২. এটি একটি আদর্শ মডেল হিসেবে ব্যবহৃত হয় যার বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব না।

ব্যবহার:
এটি তাপ ইঞ্জিনের সর্বচ্চো দক্ষতার আদর্শ মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

সুবিধা:
থার্মোডাইনামিক সাইকেলের সর্বোচ্চ তাপীয় দক্ষতা নির্ণয় করা যায়।

৫. কালিনা সাইকেল (Kalina Cycle):

এটি র‍্যাঙ্কিন সাইকেলের একটি পরিবর্তিত রূপ এবং এক্ষেত্রে পানি ও অ্যামোনিয়ার মিশ্রণকে ওয়ার্কিং ফ্লুইড হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

কার্যপ্রণালী:

পানি এবং অ্যামোনিয়ার মিশ্রণের ফলে পরিবর্তনশীল স্ফুটনাঙ্ক পাওয়া যায়। ফলে নিম্ন তাম্পমাত্রার উৎস হতে তাপ উদ্ধারের জন্য সুবিধাজনক স্ফুটনাঙ্ক তৈরি করা যায়।

ব্যবহার:
১. আবর্জনা থেকে শক্তি উৎপাদন,
২. জিওথার্মাল বিদুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি।

সুবিধা:
নিম্ন তাপমাত্রায় অধিক দক্ষতা অর্জন করা যায়।

৬. এরিকসন সাইকেল (Ericsson Cycle):

এরিকসন সাইকেল বাহিরের উৎস হতে তাপ গ্রহণ করে এবং পুনরায় তাপ উৎপন্ন করে।

কার্যপ্রণালী:
এই সাইকেলে দুইটি isothermal process এবং দুইটি isobaric processes ব্যবহৃত হয়।

ব্যবহার:
১. সোলার থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

সুবিদা:
১. উচ্চ তাত্ত্বিক দক্ষতা।

৭. অর্গানিক র‍্যাঙ্কিন সাইকেল (Organic Rankine Cycle):

পানির চেয়ে নিম্ন স্ফুটনাঙ্ক বিশিষ্ট অর্গানিক ফ্লুইড এর মাধ্যমে শক্তির রূপান্তরের ক্ষেত্রে অর্গানিক র‍্যাঙ্কিন সাইকেল ব্যবহৃত হয়।

কার্যপ্রনালী:
র‍্যাঙ্কিন সাইকেল এর মতই কাজ করে তবে তাপ উদ্ধারের জন্য নিম্ন তাপমাত্রা বিশিষ্ট অর্গানিক ফ্লুইড যেমন pentane, butane ইত্যাদি ব্যবহার করে।

ব্যবহার:
১. জিওথার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রও,
২. সোলার থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রও,
৩. ময়লা-আবর্জনা হতে তাপ উদ্ধার।

সুবিদা:
১. নিম্ন তাপমত্রা বিশিষ্ট উৎস হতে উচ্চ দক্ষতায় শক্তির রূপান্তর করা যায়।

ব্ল্যাকআউট এবং ব্রাউনআউট কি?

ভুমিকা:

বিদুৎ বিভ্রাট আমাদের সাভাবিক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটায় এবং জনজীবনে নানা রকমের সমস্যা তৈরি করে। বিদুৎ বিভ্রাটের বহুল আলোচিত দুইটি ধরন হলো ১. ব্ল্যাকআউট এবং ২. ব্রাউনআউট। শুনতে একইরকম মনে হলেও এদের কারণ, প্রভাব এবং স্থিতিকালের সুনির্দিষ্ট কিছু পার্থক্য রয়েছে।

এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা ব্ল্যাকআউট এবং ব্রাউনআউট এর কারণ, প্রভাব, পার্থক্য এবং ব্ল্যাকআউট ও ব্রাউনআউট ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।

Electrical Blackout
A boy studying in kerosene lamp due to electrical blackout
ব্ল্যাকআউট:

কোনো নির্দিষ্ট বৃহৎ এলাকা বা দেশ সম্পূর্ণ রুপে বিদুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তাকে ব্ল্যাকআউট বলে। ব্ল্যাকআউট এর স্থায়িত্ব কয়েক মিনিট হতে কয়েকদিন পর্যন্ত হতে পারে।

প্রধান বৈশিষ্ট্য:
স্থায়িত্ব: কয়েক মিনিট হতে কয়েকদিন।
ব্যাপ্তি: একটি ক্ষুদ্র এলাকা থেকে শুরু করে, একটি বৃহৎ শহর এমনকি পুরো দেশও আক্রান্ত হতে পারে।
কারণ: বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির মারাত্বক ক্ষতির কারনে গ্রিড বিপর্যয়, ওভারলোড, প্রাকৃতিক দূর্যোগ এবং সাইবার আক্রমন।

প্রভাব:
১. পরিপূর্ণ বিদ্যুৎ বিভ্রাট: সম্পূর্ণ এলাকা পুরোপুরি বিদুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
২. অর্থনৈতিক ক্ষতি: দীর্ঘসময় বিদুৎ বিচ্ছিন্ন থাকায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্যাহত হয় এবং আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয়।৩. নিরাপত্তা ঝুঁকি: ট্র্যাফিক লাইট, নিরপত্তা ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন জরুরী সেবা বিঘ্নিত হয়।

উদাহরণ:
২০০৩ সালের যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ব্ল্যাকআউট এর কারণে প্রায় ৫০ মিলিয়ন লোক বিদুৎ বিভ্রাটের সম্মুখীন হয়েছিল।

ব্ল্যাকআউট মোকাবেলায় করণীয়:
১. বৈদ্যুতিক উৎপাদন, সঞ্চালন এবং বিতরণ ব্যবস্থায় নিয়মিত পর্যবেক্ষণ রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নয়ন সাধন।
২. বিদুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন এবং বিতরণ ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি।
৩. গ্রিড কোড অনুসরণ করা।
৩. বিকল্প ব্যবস্থা যেমন জেনারেটর ইত্যাদির ব্যবস্থা করা।

ব্রাউনআউট:

সাময়িকভাবে বিদ্যুতের সরবরাহ ভোল্টেজ কমে যাওয়াকে ব্রাউনআউট বলে। ব্রাউনআউটের সময় ব্ল্যাকআউট এর মত সম্পূর্ণরূপে বিদুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে না।

প্রধান বৈশিষ্ট্য:
স্থায়িত্ব: সাধারনত স্বল্প সময়ের জন্য ঘটে এবং তা কয়েক সেকেন্ড হতে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
ব্যাপ্তি: বৈদ্যুতিক গ্রিড ব্যবস্থাপনার উপর ভিত্তি করে কোনো ছোট এলাকা থেকে শুরু করে একটি বৃহৎ অঞ্চল পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারে।
কারণ: বিদুৎ সরবরাহ সংস্থা কর্তৃক লোড হ্রাসের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ভোল্টেজে কমানো হতে পরে। বৈদ্যুতিক সুইচ গিয়ার এবং যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণেও ভোল্টেজ কমে যেতে পারে। এছাড়াও ওভারলোড এর কারণেও ভোল্টেজ হ্রাস পায়।

প্রভাব:
১. বৈদ্যুতিক বাতি ফ্লিকার করে বা মিটমিট করে জ্বলে।
২. বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি যেমন মোটর, লিফট ইত্যাদির কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়।
৩. ভোল্টেজ সংবেদনশীল যন্ত্রপাতি যেমন কম্পিউটার, রেফ্রিজারেটর, বিভিন্ন মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট ইত্যাদি সঠিকভাবে কাজ করতে ব্যার্থ হয় এমনকি স্থায়ীভাবে বিকল হয়ে যেতে পারে।

উদাহরণ:
তীব্র গরমের সময় প্রচুর পরিমাণে এয়ার কন্ডিশনার চালানোর ফলে বৈদ্যুতিক সিস্টেম ওভার লোড হয় এবং ভোল্টেজ হ্রাস পায়।

ব্রাউনআউট মোকাবেলায় করণীয়:
১. লোডের চাহিদা অনুযায়ী বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
২. দিনের বিভিন্ন সময়ের মধ্যে লোডের সুষম বণ্টন।
৩. ভোল্টেজে স্টেবিলাইজার এর ব্যবহার।

ব্ল্যাকআউট এবং ব্রাউনয়াউটের মধ্যে পার্থক্য:
পার্থক্যর বিষয়ব্ল্যাকআউটব্রাউনআউট
সংজ্ঞাস্থায়ী বিদ্যুৎ বিভ্রাট।অস্থায়ী ভোল্টেজ কমে যাওয়া।
স্থায়িত্বকয়েক মিনিট হতে কয়েক দিন।কয়েক সেকেন্ড হতে কয়েক ঘনটা।
বিদ্যুতের উপস্থিতিকোনো বিদ্যুৎ থাকে না।নিম্ন ভোল্টেজে আংশিক বিদ্যুৎ থাকে।
কারনগ্রিড বিপর্যয়, যন্ত্রপাতি বিকল হওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সাইবার আক্রমণ ইত্যাদি।ওভার লোড, গ্রিড ব্যালেন্সিং, যন্ত্রপাতির ত্রুটি ইত্যাদি।
প্রভাবসম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক বিকল হয়ে পরে।বৈদ্যুতিক বাতি মিটিমিটি করে জ্বলে, ভিবিন্ন যন্ত্রপাতি কম দক্ষতায় এবং কম সক্ষমতায় চলে।
নিরপত্যা ঝুঁকিউচ্চ, যেমন: সকল জরুরি সেবা ব্যহত হয়।মাঝারি, যেমন: যন্ত্রপাতির ক্ষতি।
উপসংহার:

ব্ল্যাকআউট এবং ব্রাউনআউট উভয়ই বিদুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটালেও তাদের কারণ, প্রভাব এবং ব্যবস্থাপনায় সুনির্দিষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকলে ব্ল্যাকআউট এবং ব্রাউনআউটকে প্রতিরোধ এবং দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করা যাবে এর এর সাথে সংশ্লিষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কমানো যাবে।

স্টেপ পোটেনশিয়াল এবং টাচ পোটেনশিয়াল: বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং প্রতিকার

ভূমিকা:

বৈদ্যুতিক সিস্টেমে, বিশেষ করে বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র বা এমন কোনো স্থাপনা যেখানে উচ্চ ভোল্টেজ ব্যবহৃত হয় সেখানে সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার জন্য স্টেপ পোটেনশিয়াল এবং টাচ পোটেনশিয়াল অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন বিষয়। উভয় বিষয়ই একটি পোটেনশিয়াল ডিফারেন্সকে নির্দেশ করে যার দ্বারা একজন ব্যক্তি মারাত্মকভাবে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হতে পরে এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। তাই বৈদ্যুতিক সিস্টেমের নিরাপদ অপারেশন এর জন্য স্টেপ পোটেনশিয়াল এবং টাচ পোটেনশিয়াল সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন। এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা স্টেপ পোটেনশিয়াল এবং টাচ পোটেনশিয়াল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবো।

স্টেপ পোটেনশিয়াল:
Step Potential
Step Potential

ভূমির দুই বিন্দুর মধ্যে ভোল্টেজ পার্থক্যকে স্টেপ পোটেনশিয়াল বলে। ভূমির দুই বিন্দুর মধ্যেকার দুরত্ব সাধারনত ১ মিটার ধরা হয়।

বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র বা কোনো স্থাপনায় যখন ফল্ট সংগঠিত হয়ে কোনো লাইভ কন্ডাক্টর গ্রাউন্ডকে স্পর্শ করে তখন ঐ স্পোর্শকৃত স্থানসহ তার আশেপাশের জায়গায় একটি বৃত্তাকার বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই বৃত্তাকার বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের কেন্দ্র যেখানে লাইভ কন্ডাক্টর ভূমিকে স্পর্শ করেছে ভোল্টেজ এর পরিমাণ সর্বোচ্চ থাকে এবং ধীরে ধীরে বৃত্তের পরিধির দিকে ভোল্টেজের মান কমতে থাকে। ফলে এই বৃত্তের দুই বিন্দুর মধ্যে একটি পোটেনশিয়াল ডিফারেন্স তৈরি হয়।

বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার সময় যখন কোনো ব্যক্তি এই বৃত্তাকার ক্ষেত্রের দুই বিন্দুতে পা রেখে দাঁড়াবে তখন তার দুই পায়ের মধ্যকার পোটেনশিয়াল ডিফারেন্স এর কারণে তার শরীর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে পারে এবং বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

প্রতিকার: স্টেপ পোটেনশিয়াল জনিত দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য দুই পা সামনে পিছে করে পদক্ষেপ না ফেলে দুই পা পাশাপাশি রেখে লাফিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যুতায়িত এলাকা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দুই পা সামনে পিছনে থাকলে স্টেপ পোটেনশিয়াল এর মান বেশি হয়। তাই দুই পা পাশাপাশি রেখে লাফিয়ে চলা নিরাপদ।

টাচ পোটেনশিয়াল:
Touch Potential
Touch Potential

কোনো ব্যক্তি যখন ভূমিতে দাঁড়িয়ে কোনো কোন বিদ্যুতায়িত যন্ত্রাংশ যেমন ট্রান্সফরমার ট্যাংক, বৈদ্যুতিক খুঁটি ইত্যাদি স্পর্শ করে তখন ঐ ব্যক্তির হাত এবং পায়ের মধ্যকার একটি পোটেনশিয়াল ডিফারেন্স তৈরি হয় এবং এই পোটেনশিয়াল ডিফারেন্স এর কারণে শরীরের মধ্য দিয়ে বিদুৎ প্রবাহিত হয়। এই পোটেনশিয়াল ডিফারেন্সকে টাচ পোটেনশিয়াল বলে। টাচ পোটেনশিয়াল এর কারণে উক্ত ব্যক্তি বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে গুরুতর দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পরে।

প্রতিকার: টাচ পোটেনশিয়াল থেকে নিরাপদ থাকার জন্য যেকোনো ধরনের বিদ্যুতায়িত যন্ত্রপাতি বা স্থাপনা খালি হাতে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যুতায়িত স্থান হতে নিরাপদ দুরত্বে সরে আসতে হবে।

স্টেপ পোটেনশিয়াল এবং টাচ পোটেনশিয়াল থেকে নিরাপদ থাকার উপায়:

১. উপযুক্ত গ্রাউন্ডিং এর ব্যবহার: উপযুক্ত গ্রাউন্ডিং এর মাধ্যমে স্টেপ পোটেনশিয়াল এবং টাচ পোটেনশিয়াল কমানো সম্ভব এবং ফল্ট কারেন্টকে কমিয়ে বিকল্প পথে প্রবাহিত করা যায়।
২. পাথর ব্যবহার: ভূমিতে পাথর ব্যবহার করে ভূমির পরিবাহীর কমানো যায় এবং কারেন্ট প্রবাহকে সীমিত করা যায়।
৩. ইকুইপটেনশিয়াল ম্যাট ব্যবহার: ইকুইপটেনশিয়াল ম্যাট ব্যবহারের মাধ্যমে স্টেপ পোটেনশিয়ালকে সমভাবে বণ্টন করা যায় ফলে স্টেপ পোটেনশিয়াল এর মান হ্রাস পায়।
৪. ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার: বিদুটোরোধী জুতা, গ্লাভস ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে টাচ পোটেনশিয়াল এবং স্টেপ পোটেনশিয়াল এর দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
৫. উপযুক্ত প্রশিক্ষণ: যথাযথ প্রশিক্ষণের দ্বারা সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।

উপসংহার:

উচ্চ ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক সিস্টেমের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা বিধানের জন্য স্টেপ পোটেনশিয়াল এবং টাচ পোটেনশিয়াল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা, উপযুক্ত যন্ত্রাংশ ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্টেপ পোটেনশিয়াল এবং টাচ পোটেনশিয়াল জনিত দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।

ইলেকট্রিক্যাল ট্রান্সমিশন লাইনে কেনো এলুমিনিয়াম কন্ডাক্টর ব্যবহার করা হয়?

ইলেকট্রিক্যাল ট্রান্সমিশন লাইনে এলুমিনিয়াম কন্ডাক্টর ব্যবহারের কারণ: কপারের তুলনায় অ্যালুমিনিয়াম কন্ডাক্টরের সুভিদা।
Aluminum Conductor VS Copper Conductor
Aluminum Conductor VS Copper Conductor

কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য ইলেকট্রিক্যাল ট্রান্সমিশন লাইনে কন্ডাক্টর হিসেবে কপারের পরিবর্তে এলুমিনিয়াম ব্যবহার করা হয়। এলুমিনিয়ামের তুলনায় কপার অধিক পরিবাহী হওয়া সত্ত্বেও এলুমিনিয়াম কন্ডাক্টর এর ব্যয়, দক্ষতা এবং বাস্তবিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ সুবিধা রয়েছে, যেমন:

১। কম ব্যয়:
কপারের তুলনায় এলুমিনিয়াম কম ব্যয়বহুল। বড় সঞ্চালন লাইন নির্মাণের ক্ষেত্রে কন্ডাক্টরের ব্যয় অন্যতম বিবেচ্য বিষয়। তাই সঞ্চালন লাইন নির্মাণের ক্ষেত্রে কপারের তুলনায় এলুমিনিয়াম কন্ডাক্টরকে প্রাধান্য দেয়া হয়।

২। ওজন হালকা:
কপারের তুলনায় এলুমিনিয়াম প্রায় এক তৃতীয়াংশ হালকা। তাই একই আয়তনের কপারের তুলনায় এলুমিনিয়াম কন্ডাক্টর ওজনে হালকা হওয়ায় সঞ্চালন লাইন নির্মাণের ক্ষেত্রে এলুমিনিয়াম কন্ডাক্টর ব্যবহার করা হয়। ওজন হালকা হওয়ার কন্ডাক্টর পরিবহন, ব্যবস্থাপনা এবং স্থাপন সহজ হয়। কন্ডাক্টরের ওজন কম হওয়ার সঞ্চালন লাইনের টাওয়ার এর উপর কম লোড পরে এবং অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী টাওয়ার ও সহায়ক যন্ত্রপাতি দরকার হয়। ফলে সার্বিক খরচ কম লাগে।

৩। উচ্চ স্ট্রেংথ টু ওয়েট রেশিও:
এলুমিনিয়াম কন্ডাক্টর হিসেবে প্রধানত সংকরায়িত রি-ইনফোর্সড কন্ডাক্টর ব্যবহার করা হয়, যেমন: Aluminium Conductor Steel Reinforced(ACSR)। এই রি-ইনফোর্সড কন্ডাক্টর সমূহ ওজনে হালকা হওয়া সত্ত্বেও এদের স্ট্রেংথ টু ওয়েট রেশিও খুবই উচ্চ মানের হয়। ফলে লম্বা স্প্যান যুক্ত সঞ্চালন লাইন নির্মাণ সম্ভব হয় এবং সঞ্চালন টাওয়ার সংখ্যা ও ব্যয় হ্রাস পায়।

৪। মরিচা প্রতিরোধী:
এলুমিনিয়াম বাতাসের সংস্পর্শে আসলে এর উপর মরিচা প্রতিরোধী অক্সাইড এর আবরণ তৈরি হয়। এই আবরণের ফলে পর্বর্তনশীল আবহাওয়াও কন্ডাক্টর দীর্ঘদিন কোনো রকম ক্ষতি ছাড়াই টিকে থাকতে পরে।

৫। সহজলভ্য এবং টেকসই:
কপারের তুলনায় এলুমিনিয়াম অধিক সহজলভ্য এবং এলুমিনিয়াম পুনব্যবহারযোগ্য হওয়ায় এটি কন্ডাক্টর হিসেবে পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই।

৬। নিরাপত্তা:
কপারের তুলনায় এলুমিনিয়াম দামে সস্তা হওয়ায় এর চুরি হয়ে যাওয়ার প্রবণতা কম। তাই সঞ্চালন লাইনে এলুমিনিয়াম এর ব্যবহার অধিক নিরাপদ।

কপার এবং এলুমিনিয়াম কন্ডাক্টর এর মৌলিক পার্থক্য:
পার্থক্যর বিষয়এলুমিনিয়ামকপার
দামসস্তাব্যায়বহুল
ওজনহালকাভারি
পরিবাহিতাকম(~কপারের ৬০%)বেশি
মরিচা রোধ ক্ষমতাভালো (অক্সাইডের আবরণ তৈরি হয়)মরিচা রোধ ক্ষমতা
প্রাপ্যতাসহজলভ্যসীমিত
চুরির সম্ভাবনাকমবেশি
উপসংহার:

সঞ্চালন লাইনে কম ব্যয়, ওজনে হালকা, পর্যাপ্ত পরিবাহিতা এবং মরিচা প্রতিরোধী হওয়ায় কপারের পরিবর্তে এলুমিনিয়াম কন্ডাক্টর ব্যবহার করা হয়। কপার অধিক পরিবাহী এবং শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও অতিরিক্ত ওজন এবং উচ্চ ব্যয়ের কারণে দীর্ঘ দুরত্বের সঞ্চালন লাইনে কপার ব্যবহার করা হয় না। দক্ষতা, প্রাচুর্যতা এবং ব্যয়ের মধ্যে সুষম সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে আধুনিক সঞ্চালন লাইন নির্মাণে এলুমিনিয়াম কন্ডাক্টর নিজেকে নির্ভরযোগ্য এবং দক্ষ পরিবাহী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ইলেকট্রিক্যাল সঞ্চালন লাইনে কি কি ফল্ট ঘটে?

ভূমিকা(Introduction):
Faults in Electrical Transmission Lines
Faults in Electrical Transmission Lines

বৈদ্যুতিক সিস্টেমে ফল্ট হলো এমন কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা যার ফলে স্বাভাবিক বিদুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে এবং সরঞ্জামের ক্ষতি সাধন হয় বা নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়। সাধারণত কয়টি ফেজে ফল্ট সংঘঠিত হয়েছে এবং কি ধরনের ফল্ট সংঘঠিত হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে ফল্টকে শ্রেণী বিন্যাস করা হয়ে থাকে। এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইন সংঘঠিত ফল্ট, ফল্ট এর কারণ এবং তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবো।

বৈদ্যুতিক সিস্টেম প্রধানত দুই ধরনের ফল্ট সংঘঠিত হয়ে থাকে, যথা: 1. সিমেট্রিক্যাল ফল্ট এবং 2. আন-সিমেট্রিক্যাল ফল্ট।

1. সিমেট্রিক্যাল ফল্ট(Symmetrical Fault):

ফল্ট সংঘঠনের সময় যখন ট্রান্সমিশন লাইনের তিন ফেজেই সমান ফল্ট কারেন্ট প্রবাহিত হয় তখন তাকে সিমেট্রিক্যাল ফল্ট বলে। একে তিন ফেজ ফল্টও বলা হয়ে থাকে। যদিও বৈদ্যুতিক সিস্টেমে সিমেট্রিক্যাল খুবই কম সংঘঠিত হয় তবে এই ফল্ট বৈদ্যুতিক সিস্টেমের জন্য মারাত্বক ক্ষতির কারণ হতে পারে এবং খুবই তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়া দরকার হয়।

i. তিন ফেজ শর্ট সার্কিট ফল্ট(Three Phase Short Circuit Fault):
Three phase short circuit fau
Three Phase Short Circuit Fault

যখন সঞ্চালন লাইনের তিন ফেজ একত্রে এক অপরকে স্পর্শ করে বা শর্ট সার্কিট হয় তখন সিমেট্রিক্যাল ফল্ট সংঘঠিত হয়।

  • কারণ: ইন্সুলেশন ফেইলর, বজ্রপাত বা ফিজিক্যাল ড্যামেজ যেমন তারের উপর গাছ পরে তার ছিঁড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
  • প্রভাব: ফল্ট এর সময় অতি উচ্চ কারেন্ট প্রবাহিত হয় এবং সঞ্চালন লাইন ও লাইনের সাথে যুক্ত যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
  • পরিমাণ: বৈদ্যুতিক সিস্টেমে সংগঠিত ফল্ট এর শতকরা ৫% বা তার কম সিমেট্রিক্যাল ফল্ট হয়ে থাকে।
ii. তিন ফেজ গ্রাউন্ড ফল্ট(Three Phase Ground Fault):

বৈদ্যুতিক লাইনের তিনটি ফেজ যখন একত্রে গ্রাউন্ড স্পর্শ করে তখন তাকে তিন ফেজ গ্রাউন্ড ফল্ট বলে। বৈদ্যুতিক সিস্টেমে তিন ফেজ গ্রাউন্ড ফল্ট ঘটেনা বললেই চলে তবে এই ফল্টের ঘটলে বৈদ্যুতিক সিস্টেম এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত যন্ত্রপাতির মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়।

2. আন-সিমেট্রিক্যাল ফল্ট(Unsymmetrical Fault):

বৈদ্যুতিক সিস্টেমে যখন কোনো এক বা দুই ফেজে ফল্ট সংগঠিত হয় তখন তাকে আন-সিমেট্রিক্যাল ফল্ট বলে। ট্রান্সমিশন লাইনে সংঘঠিত বেশিরভাগ ফল্টই আন-সিমেট্রিক্যাল ফল্ট। তিন ধরনের আন-সিমেট্রিক্যাল ফল্ট সংঘঠিত হয়ে থাকে, যথা:

i. সিঙ্গেল লাইন টু গ্রাউন্ড ফল্ট(Single Line to Ground Fault or L-G Fault):
Single Line to Ground Fault
Single Line to Ground Fault

যখন কোনো অনাকাঙ্খিত কারণে বৈদ্যুতিক লাইনের এক ফেজ গ্রাউন্ড স্পর্শ করে তখন তাকে সিঙ্গেল লাইন টু গ্রাউন্ড ফল্ট বলে।

  • কারণ: বজ্রপাত, লাইনের উপর গাছ পড়া, ইন্সুলেশন ডেমেজ ইত্যাদি।
  • প্রভাব: যেই ফেজে ফল্ট সংঘঠিত হয়েছে সেই ফেজে উচ্চ ফল্ট কারেন্ট প্রবাহিত হয় তবে তা সিমেট্রিক্যাল ফল্ট এর তুলনায় কম বিপদজনক।
  • পরিমাণ: বৈদ্যুতিক সিস্টেমের ফল্ট সমূহের মধ্যে সবচে বেশি সংঘঠিত হয় সিঙ্গেল লাইন টু গ্রাউন্ড ফল্ট। মোট ফল্ট এর প্রায় ৭০% ফল্টই সিঙ্গেল লাইন টু গ্রাউন্ড ফল্ট।
ii. লাইন টু লাইন ফল্ট(Line to Line Fault or L-L Fault):
Line to Line Fault
Line to Line Fault

যখন বৈদ্যুতিক লাইনের দুই ফেজের মধ্যে শর্ট সার্কিট সংঘঠিত হয় তাকে লাইন টু লাইন ফল্ট বলে।

  • কারণ: ইন্সুলেশন ফেইলিওর অথবা ফিজিক্যাল ডেমেজ।
  • প্রভাব: লাইনে অসম কারেন্ট প্রবাহিত হয় এবং যন্ত্রপাতির ক্ষতি সাধন করে।
  • পরিমাণ: বিতরণ লাইনে সংঘঠিত ফল্ট এর প্রায় 15% লাইন টু লাইন ফল্ট।
iii. ডাবল লাইন টু গ্রাউন্ড ফল্ট(Double Line to Ground Fault or L-L-G Fault):
Double Line to Ground Fault
Double Line to Ground Fault

যখন বৈদ্যুতিক লাইনের দুটি ফেজ একত্রে গ্রাউন্ড স্পর্শ করে তখন তাকে ডাবল লাইন টু গ্রাউন্ড ফল্ট বলে।

  • কারণ: প্রবল ঝড়, প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ডাবল লাইন টু গ্রাউন্ড ফল্ট সংগঠিত হয় ।
  • প্রভাব: লাইনে অসম কারেন্ট প্রবাহিত হয় এবং মারাত্বক ক্ষতি সাধন করে।
  • পরিমাণ: বৈদ্যুতিক লাইন সংঘঠিত ফল্ট এর প্রায় ১০% ডাবল লাইন টু গ্রাউন্ড ফল্ট।
4. ওপেন সার্কিট ফল্ট(Open Circuit Fault):

বৈদ্যুতিক লাইনের এক বা একাধিক ফেজ এর সংযোগ অনাকাঙ্খিত কারণে বিচ্ছিন্ন হলে তাকে ওপেন সার্কিট ফল্ট বলে। ফল্ট এর কারণে কতটি ফেজ বিচ্ছিন্ন হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে ওপেন সার্কিট ফল্টকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা:

  1. এক ফেজ ওপেন সার্কিট,
  2. দুই ফেজ ওপেন সার্কিট এবং
  3. তিন ফেজ ওপেন সার্কিট ফল্ট।

স্কিন ইফেক্ট: কারণ, অসুবিধা এবং প্রতিকার

ভূমিকা(Introduction):

ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার সিস্টেমে স্কিন ইফেক্ট একটু গুরুত্বপুর্ন ঘটনা যা পরিবাহীর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত কারেন্টের প্রবাহকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষকরে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতে এই প্রভাব খুবই তীব্র যা পাওয়ার সিস্টেমের দক্ষতা, ট্রান্সমিশন লাইন ডিজাইন এবং এনার্জি লসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে স্কিন ইফেক্ট সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। এই পোস্টে আমরা স্কিন ইফেক্ট কি, স্কিন ইফেক্ট কেনো হয় এবং ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার সিস্টেমে স্কিন ইফেক্ট এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবো।

স্কিন ইফেক্ট(Skin Effect):

কোনো পরিবাহীর মধ্য দিয়ে অল্টারনেটিং কারেন্ট(AC) প্রবাহিত হওয়ার সময় কারেন্ট ওই পরিবাহীর সম্পূর্ণ ক্ষেত্রফল জুড়ে সুষমভাবে প্রবাহিত না হয়ে শুধুমাত্র পরিবাহীর বাহিরের বা উপরের পৃষ্ঠ দিয়ে প্রবাহিত প্রবণতাকে স্কিন ইফেক্ট বলে। এর ফলে পরিবাহীর মধ্য দিয়ে কারেন্ট প্রবাহের জন্য কার্যকরী ক্ষেত্রফল হ্রাস পায় এবং ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধির সাথে সাথে এই সমস্যা আরো তীব্র হয়।সহজ ভাষায়, যখন ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধি পায় তখন পরিবাহীর কেন্দ্রের তুলনায় বাহিরের স্তরে কারেন্টের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। ফলে পরিবাহীর রোধ বৃদ্ধি পায়। নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে এই প্রভাব অতি সামান্য হলেও উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতে এর প্রভাব তীব্র যা পাওয়ার সিস্টেমের দক্ষতা হ্রাস পায়, পাওয়ার অপচয় হয় এবং খরচ বৃদ্ধি পায়।

স্কিন ইফেক্ট এর কারণ(Reason of Skin Effect):

পরিবাহীর ভিতরের ইন্ডাক্টিভ রিয়াক্টেন্সের জন্য স্কিন ইফেক্ট হয়। কোন পরিবাহীর ভিতর দিয়ে যখন পরিবর্তনশীল কারেন্ট(AC) প্রবাহিত হয় তখন ঐ পরিবাহীর চারপাশে একটি চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই চুম্বক ক্ষেত্র নিজেই পরিবাহীর মধ্য দিয়ে একটি কারেন্ট প্রবাহিত করে যা মূল কারেন্টের বিপরীত হওয়ায় মূল কারেন্টের প্রবাহকেই বাধা প্রদান করে। ফলস্বরূপ, মূল কারেন্ট পরিবাহীর কেন্দ্র হতে সরে এসে বাহিরের পৃষ্ঠ দিয়ে চলাচলের চেষ্টা করে। যারফলে পরিবাহীর বাহিরের পৃষ্ঠে কারেন্টের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায় এবং পরিবাহীর কার্যকরী রোধ বৃদ্ধি পায়।

পরিবাহীর বাহিরের পৃষ্ঠ হতে কেন্দ্রের দিকে যে দুরত্বে কারেন্ট ঘনত্ব পরিবাহী পৃষ্ঠের কারেন্ট ঘনত্বের ৩৭% এ নেমে আসে তাকে স্কিন ডেপ্থ(skin depth) বা পেনিট্রেশন ডেপ্থ(penetration depth) বলে। একে গ্রীক অক্ষর δ(ডেল্টা) দ্বারা প্রকাশ করা হয় যা উপরের চিত্রে দেখানো হয়েছে। গাণিতিকভাবে ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ার সাথে সাথে স্কিন ডেপ্থ কমে যায় এবং স্কিন ডেপ্থ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে যেমন:

১. পরিবর্তনশীল কারেন্টের ফ্রিকোয়েন্সি (Frequency),

২. পরিবাহীর পরিবাহিতা (Conductivity),

৩. পরিবাহীর ভেদ্যতা (Permeability) এবং

৪. পরিবাহীর গঠন।

পাওয়ার সিস্টেমে স্কিন ইফেক্ট এর প্রভাব(Affect of skin effect in Power System):

১. রেজিস্ট্যান্স এবং পাওয়ার লস বৃদ্ধি: যেহেতু স্কিন ইফেক্টের কারণে কারেন্ট পরিবাহী পৃষ্ঠে কারেন্ট ঘনীভূত হয়ে পরিবাহীর সম্পূর্ণ ক্ষেত্রফল দিয়ে প্রবাহিত না হয়ে পরিবাহী পৃষ্ঠ দিয়ে প্রবাহিত হয় তাই পরিবাহীর কার্যকরী দৈর্ঘ্য হ্রাস পেয়ে পরিবাহীর রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধি পায়। ফলে I²*R লসও বৃদ্ধি পায়। বিশেষত উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতে এই লসের পরিমাণ অনেক বেশি হয়। ফলে দক্ষতা কমে যায়।

২. পরিবাহীর দক্ষতা হ্রাস: যেহেতু স্কিন ইফেক্ট এর কারণে পরিবাহীর কার্যকরী ক্ষেত্রফল কমে যায় ফলে একই পরিমাণ কারেন্টের জন্য উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতে বড় ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট পরিবাহী ব্যবহার করতে হয়। এতে করে পরিবাহীর ওজন বৃদ্ধি পায়, বড় আকারের পোল এবং অন্যান্য উপাদান ব্যবহার করতে হয়। সর্বোপরি বিদুৎ পরিবহনের খরচ বৃদ্ধি পায়।

৩. পরিবাহীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি: যেহেতু স্কিন ইফেক্ট এর কারণে পরিবাহীর রোধ এবং পাওয়ার লস বৃদ্ধি পায়, সেহেতু পাওয়ার লসের কারণে পরিবাহীর তাপমাত্রায়ও বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ট্রান্সফর্মারের উইন্ডিংসহ বিভিন্ন উপাদান ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং কার্যকাল হ্রাস পায়।

৪. সঞ্চালন লাইনের উপর প্রভাব: দীর্ঘ দুরত্বে পাওয়ার পরিবহনের সময় পাওয়ার লস হ্রাসের লক্ষেই সঞ্চালন লাইন ডিজাইন করা হয়। হাই ভোল্টেজ সঞ্চালন লাইনের ক্ষেত্রে(৫০-৬০ হার্টজ) স্কিন ইফেক্ট জনিত লস খুব সামান্য হলেও সঞ্চালন লাইন ডিজাইনের ক্ষেত্রে তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়।

স্কিন ইফেক্ট কমানোর উপায়(Way to reduce skin effect):

বিশেষত উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতে ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্কিন ইফেক্ট কমানোর জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা হয়, যেমন:

১. ফাঁপা পরিবাহী ব্যবহার: যেহেতু স্কিন ইফেক্ট এর কারণে কারেন্ট পরিবাহী পৃষ্ঠ দিয়ে প্রবাহিত হয় তাই ফাঁপা পরিবাহী ব্যবহার করা হলে পরিবাহীর ওজন হ্রাস পায়, ফলে সামগ্রিক খরচ হ্রাস পায় এবং দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।

২. বান্ডলড(Bundled) বা একাধিক খেইযুক্ত(Stranded) পরিবাহী ব্যবহার: একক পরিবাহীর তুলনায় কয়েকটি পরিবাহিকে একত্রে বান্ডিল আকারে ব্যবহার করলে পরিবাহীর সমগ্র ক্ষেত্রফল জুড়ে সুষম কারেন্ট প্রবাহিত হয় এবং স্কিন ইফেক্ট হ্রাস পায়।

৩. পরিবাহীর আকার বৃদ্ধি: অপেক্ষাকৃত বড় ক্ষেত্রফল যুক্ত পরিবাহীর কার্যকরী ক্ষেত্রফল বেশি হওয়ায় স্কিন ইফেক্ট কম হয় এবং স্কিন ইফেক্ট এর কারনে সৃষ্ট লস হ্রাস পায়। তবে পরিবাহীর আকার বৃদ্ধির কারণে পরিবাহীর ওজন ও খরচ উভয়ই বৃদ্ধি পায়।

৪. লিটজ্ তারের(Litz Wire) ব্যবহার: কয়েকটি পরিবাহীর খেইয়ে(Strand) আলাদা আলাদা ভাবে ইনস্যুলেশন পেঁচিয়ে সবগুলি খেইকে একসাথে বুননের মাধ্যমে লিটজ্ তার তৈরি করা হয়। এই তার কয়েক কিলো হার্জ থেকে এক মেগাহার্জ পর্যন্ত ফ্রিকোয়েন্সির স্কিন ইফেক্ট কমাতে পারে।

৫. নিম্ন ভেদ্যতা(Permeability) এবং পরিবাহিতা যুক্ত পরিবাহির ব্যবহার: নিন্ম ভেদ্যতা যুক্ত ক্যাবলে স্কিন এফেক্ট কম হয় এবং ক্যাবলের পরিবাহিতা বেশি হলে লস কম হয়।

উপসংহার(Conclusion):

বৈদ্যুতিক পাওয়ার সিস্টেমে স্কিন ইফেক্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, বিশেষ করে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতে অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে এর প্রভাব তীব্র। তাই স্কিন ইফেক্ট সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা থাকলে একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এর পক্ষে সঠিক ম্যাটেরিয়ালের ক্যাবল নির্বাচন করা, ক্যাবলের আকার নির্ধারণ করাসহ ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম ডিজাইনের অন্যান সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে এবং কম খরচে দক্ষ ইলেকট্রিক্যাল নেটওয়ার্ক তৈরিতে সক্ষম হবে।