ভূমিকা:

বৈদ্যুতিক পাওয়ার উৎপাদনে থার্মোডাইনামিক সাইকেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কারণ পাওয়ার উৎপাদনে ব্যবহৃত থার্মোডাইনামিক সাইকেলই নির্ধারণ করে কিভাবে তাপীয় শক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর ঘটবে এবং রূপান্তরের দক্ষতা কেমন হবে। প্রতিটি থার্মোডাইনামিক সাইকেলের দক্ষতা, ব্যবহৃত জ্বালানির ধরন এবং অপারেটিং কন্ডিশন বিবেচনা করে একেক অবস্থায় একেক থার্মোডাইনামিক সাইকেল ব্যবহার করা হয়।

এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা বৈদ্যুতিক পাওয়ার উৎপাদনে ব্যবহৃত বিভিন্ন থার্মোডাইনামিক সাইকেল ও তাদের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।

থার্মোডাইনামিক সাইকেল (Thermodynamic Cycle):

থার্মোডাইনামিক সাইকেল হল এক ধরনের প্রক্রিয়া যেখানে একটি পদার্থ একাধিক ধাপ অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত আবার তার প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে আসে। এই প্রক্রিয়ায় তাপ এবং কাজের আদান-প্রদান হয়। সহজ কথায়, এটি একটি ঘূর্ণায়মান প্রক্রিয়া যেখানে একটি পদার্থ একই চক্রের ভিতর দিয়ে দিয়ে বারবার অতিক্রম করে। এই প্রক্রিয়াগুলিতে সিস্টেম তাপ শক্তি গ্রহণ বা সরবরাহ করে এবং তা যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে বা বিপরীতভাবে যান্ত্রিক শক্তিকে তাপ শক্তিতে রূপান্তর করে।

একটি থার্মোডাইনামিক সাইকেল সাধারণত চারটি ধাপের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়:
1. প্রসারণ (Expansion): তাপে সিস্টেম প্রসারিত হয়।
2. তাপ সরবরাহ (Heat Addition): সিস্টেমে বাহ্যিক তাপ সরবরাহ করা হয়।
3. সংকোচন (Compression): সিস্টেম সংকুচিত হয়।
4. তাপ অপসারণ (Heat Rejection): সিস্টেম থেকে তাপ অপসারণ করা হয়।

বিদুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত থার্মোডাইনামিক সাইকেল সমূহ:

১. র‍্যাঙ্কিন সাইকেল (Rankine Cycle):

বিদুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত থার্মোডাইনামিক সাইকেল হলো র‍্যাঙ্কিন সাইকেল।

কার্যপ্রণালী:


১. পানিকে উত্তপ্ত করে বাষ্প উৎপন্ন করা হয় এবং এই উৎপন্ন বাষ্পের মাধ্যমে টারবাইনকে ঘুরিয়ে যান্ত্রিক তাপ শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করা হয়।
২. এই সাইকেলটি চারটি প্রধান ধাপে সম্পন্ন হয়, যথা: ১. isobaric heat addition, ২. adiabatic expansion, ৩. isobaric heat rejection, এবং ৪. adiabatic compression.

ব্যবহার:
১. তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং
২. পারমাণবিক বিদুৎ কেন্দ্র।

সুবিধা:
১. আধুনিক প্রযুক্তি যেমন Reheating এবং Regenerative Feed Water Heating ব্যবহার করে উচ্চ দক্ষতা অর্জন করা যায়।

২. ব্রেইটন সাইকেল (Brayton Cycle):

ব্রেইটন সাইকেল সাধারনত গ্যাস টারবাইন বিদুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার করা হয়।

কার্যপ্রণালী:

১. বাতাসকে সংকুচিত করে জ্বালানির সাথে মিশ্রিত করা হয় এবং কম্বাসন চেম্বারের মধ্যে পোড়ানো হয়। ফলে এই উত্তপ্ত গ্যাস এর চাপ বৃদ্ধি পায় এবং এই উত্তপ্ত গ্যাসকে টারবাইনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করে টারবাইনকে ঘুরানো হয়।
২. এই সাইকেল চারটি প্রধান ধাপে সম্পন্ন হয়, যথা: ১. isobaric heat addition, ২. adiabatic compression, ৩. adiabatic expansion এবং ৪. isobaric heat rejection.

ব্যবহার:
১. গ্যাস টারবাইন বিদুৎ কেন্দ্র,
২. কম্বাইন্ড সাইকেল বিদুৎ কেন্দ্র,
৩. উড্ডয়ন শিল্প ইত্যাদি।

সুবিধা:
পিক লোডের জন্য দ্রুত স্ট্রাটঅপ সুবিধা পাওয়া যায়।

৩. কম্বাইন্ড সাইকেল (Combined Cycle):

সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে র‍্যাঙ্কিন সাইকেল এবং ব্রেইটন সাইকেল কে একত্রে ব্যবহার করা হয় যা কম্বাইন্ড সাইকেল নামে পরিচিত।

কার্যপ্রণালী:

ব্রেইটন সাইকেলের গ্যাস টারবাইন হতে নির্গত গ্যাসের তাপকে কাজে লাগিয়ে র‍্যাঙ্কিন সাইকেলের মাধ্যমে বাষ্প উৎপন্ন করে স্টিম টারবাইনকে ঘুরানো হয় এবং বিদুৎ উৎপাদন করা হয়।

ব্যবহার:
বর্তমানে বেশিভাগ আধুনিক বিদুৎ কেন্দ্রই কম্বাইন্ড সাইকেল ব্যবহার করে বিদুৎ উৎপাদন করা হয়। এতে বিদুৎ কেন্দ্রের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।

সুবিধা:
কম্বাইন্ড সাইকেল বিদুৎ কেন্দ্রের দক্ষতা র‍্যাঙ্কিন সাইকেল এবং ব্রেইটন সাইকেলের থেকে তুলনামুলক বেশি হয় এবং এটি ৬০% পর্যন্ত দক্ষতায় শক্তির রূপান্তর করতে পারে।

৪. কার্নো সাইকেল (Carnot Cycle):

কার্নো সাইকেল একটি তাত্ত্বিক মডেল যা তাপ ইঞ্জিনের সর্বচ্চো তাপীয় দক্ষতা নির্ণয়ে ব্যবহার করা হয়।

কার্যপ্রণালী:

১. দুটি isothermal processes এবং two adiabatic processes এর মাধ্যমে শক্তির রূপান্তর ঘটে।
২. এটি একটি আদর্শ মডেল হিসেবে ব্যবহৃত হয় যার বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব না।

ব্যবহার:
এটি তাপ ইঞ্জিনের সর্বচ্চো দক্ষতার আদর্শ মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

সুবিধা:
থার্মোডাইনামিক সাইকেলের সর্বোচ্চ তাপীয় দক্ষতা নির্ণয় করা যায়।

৫. কালিনা সাইকেল (Kalina Cycle):

এটি র‍্যাঙ্কিন সাইকেলের একটি পরিবর্তিত রূপ এবং এক্ষেত্রে পানি ও অ্যামোনিয়ার মিশ্রণকে ওয়ার্কিং ফ্লুইড হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

কার্যপ্রণালী:

পানি এবং অ্যামোনিয়ার মিশ্রণের ফলে পরিবর্তনশীল স্ফুটনাঙ্ক পাওয়া যায়। ফলে নিম্ন তাম্পমাত্রার উৎস হতে তাপ উদ্ধারের জন্য সুবিধাজনক স্ফুটনাঙ্ক তৈরি করা যায়।

ব্যবহার:
১. আবর্জনা থেকে শক্তি উৎপাদন,
২. জিওথার্মাল বিদুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি।

সুবিধা:
নিম্ন তাপমাত্রায় অধিক দক্ষতা অর্জন করা যায়।

৬. এরিকসন সাইকেল (Ericsson Cycle):

এরিকসন সাইকেল বাহিরের উৎস হতে তাপ গ্রহণ করে এবং পুনরায় তাপ উৎপন্ন করে।

কার্যপ্রণালী:
এই সাইকেলে দুইটি isothermal process এবং দুইটি isobaric processes ব্যবহৃত হয়।

ব্যবহার:
১. সোলার থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

সুবিদা:
১. উচ্চ তাত্ত্বিক দক্ষতা।

৭. অর্গানিক র‍্যাঙ্কিন সাইকেল (Organic Rankine Cycle):

পানির চেয়ে নিম্ন স্ফুটনাঙ্ক বিশিষ্ট অর্গানিক ফ্লুইড এর মাধ্যমে শক্তির রূপান্তরের ক্ষেত্রে অর্গানিক র‍্যাঙ্কিন সাইকেল ব্যবহৃত হয়।

কার্যপ্রনালী:
র‍্যাঙ্কিন সাইকেল এর মতই কাজ করে তবে তাপ উদ্ধারের জন্য নিম্ন তাপমাত্রা বিশিষ্ট অর্গানিক ফ্লুইড যেমন pentane, butane ইত্যাদি ব্যবহার করে।

ব্যবহার:
১. জিওথার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রও,
২. সোলার থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রও,
৩. ময়লা-আবর্জনা হতে তাপ উদ্ধার।

সুবিদা:
১. নিম্ন তাপমত্রা বিশিষ্ট উৎস হতে উচ্চ দক্ষতায় শক্তির রূপান্তর করা যায়।

Leave a Comment