ট্রান্সফরমারে কি কি টেস্ট করা হয়?

ভূমিকা(Introduction):

ইলেক্ট্রিক্যাল সিস্টেমে ট্রান্সফরমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান এবং সেই কারণেই নিয়মিত টেস্টিং মাধ্যমে ট্রান্সফর্মারের দক্ষতা, নির্ভরযোগ্যতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। ট্রান্সফর্মারের টেস্টসমূহকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়ঃ ১। রুটিন টেস্ট এবং ২। টাইপ টেস্ট। এছাড়াও, বিশেষ পরিস্থিতিতে কিছু বিশেষ টেস্ট করা হয়ে থাকে যা স্পেশাল টেস্ট নামে পরিচিত। এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা ট্রান্সফর্মারের বিভিন্ন টেস্ট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

1. টাইপ টেস্ট(Type Test):

প্রস্তুতকারক কর্তৃক ট্রান্সফর্মার বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের পূর্বে ট্রান্সফর্মারের যে প্রোটোটাইপ তৈরি করা হয় সেসব প্রোটোটাইপ ট্রান্সফর্মারের ডিজাইন এবং আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের সাথে সামঞ্জস্যতা প্রমাণের জন্য টাইপ টেস্ট করা হয় থাকে। এই টেস্টগুলি কোনো প্রোডাকশন গ্রুপের সব ট্রান্সফর্মারে না করে কিছু স্যাম্পল ইউনিটের উপর করা হয়। এই টেস্টের অন্তর্গত কিছু পরিচিত টেস্ট হলো:

  1. তাপমাত্রা বৃদ্ধি পরীক্ষা(Temperature Rise Test): ফুল লোডে তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য ট্রান্সফর্মারের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পরীক্ষা করা হয়। টেস্ট চলাকালীন ট্রান্সফর্মারে ফুল লোড প্রয়োগ করা হয় এবং টেম্পারেচার সেন্সরের মাধ্যমে উইন্ডিং এবং অয়েলের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
  2. ইম্পালস্‌ টেস্ট(Impulse Test): বজ্রপাত এবং সুইচিং সার্জ হতে সুরক্ষিত থাকার ক্ষমতা পরীক্ষার জন্য ইম্পালস্‌ টেস্ট করা হয়। এই টেস্টে ট্রান্সফর্মারে হাই-ভোল্টেজ ইম্পালস্‌ ওয়েভ প্রয়োগ করে ট্রান্সফর্মারের ইন্সুলেশনের কার্যকারিতা পর্যবেক্ষন করা হয়।
  3. নয়েজ লেভেল টেস্ট(Noise Level Test): ভিভিন্ন পরিস্থিতিতে ট্রান্সফর্মার কর্তৃক উৎপন্ন শব্দের মাত্রা পরীক্ষার জন্য নয়েজ লেভেল টেস্ট করা হয়।
  4. হারমনিক কনটেন্ট টেস্ট(Harmonic Content Test): ট্রান্সফর্মার চলার সময় উৎপন্ন হারমনিক পরিমাপ করার জন্য হারমনিক কনটেন্ট টেস্ট করা হয়।
2. রুটিন টেস্ট(Routine Test):

ফ্যাক্টরি হতে ডেলিভারির পূর্বে প্রতিটি ট্রান্সফর্মারে রুটিন টেস্ট করা হয়। প্রতিটি ট্রান্সফর্মারের দক্ষতা এবং নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত করার জন্য নিম্নবর্নিত টেস্টসমূহ করা হয়ঃ

  1. উইন্ডিং রেজিস্ট্যান্স টেস্ট(Winding Resistance Test): ট্রান্সফর্মারের প্রাইমারী এবং সেকেন্ডারি উইন্ডিং এর রেজিস্ট্যান্স পরিমাপের জন্য উইন্ডিং রেজিস্ট্যান্স টেস্ট করা হয়। ট্রান্সফর্মারের উইন্ডিং এ কোন লুজ কানেকশন এবং ড্যামেজ আছে কিনা তা এই পরীক্ষার মাধ্যমে জানা জায়। এই টেস্টে ট্রান্সফর্মারের উইন্ডিং এর মধ্য দিয়ে ডিসি কারেন্ট প্রবাহিত করে উইন্ডিং এর ভোল্টেজ ড্রপ পরিমাপের মাধ্যমে উইন্ডিং এর রেজিস্ট্যান্স পরিমাপ করা হয়।
  2. ভোল্টেজ রেশিও টেস্ট(Voltage Ratio Test): ট্রান্সফর্মারের ডিজাইন এর চাহিদা মোতাবেক ট্রান্সফর্মারের ভোল্টেজ রেশিও ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য ভোল্টেজ রেশিও টেস্ট করা হয়। রেশিও পরিমাপের জন্য একটি জানা উৎস হতে ট্রান্সফর্মারের প্রাইমারী উইন্ডিং এ ভোল্টেজ সরবরাহ করে সেকেন্ডারি উইন্ডিং এ ভোল্টেজ পরিমাপ করা হয়।
  3. নো-লোড টেস্ট(No Load test or Open Circuit Test):  ট্রান্সফর্মারের কোর লস(Core Loss) বা আইরন লস(Iron Loss) পরিমাপের জন্য নো-লোড টেস্ট করা হয়। এই টেস্টে ট্রান্সফর্মারে সেকেন্ডারি উইন্ডিং খোলা রেখে প্রাইমারী উইন্ডিং রেটেড ভোল্টেজ প্রয়োগ করা হয় এবং ট্রান্সফর্মারের ব্যবহৃত পাওয়ার পরিমাপ করা হয়। এই পরিমাপকৃত পাওয়ারই কোর লস।
  4. শর্ট সার্কিট টেস্ট(Short Ciruit Test): ট্রান্সফর্মারের কপার লস এবং উইন্ডিং ইম্পিডেন্স পরিমাপ করার জন্য শর্ট সার্কিট টেস্ট করা হয়। এই টেস্টে ট্রান্সফর্মারের লো- ভোল্টেজ উইন্ডিংকে শর্ট করে প্রাইমারী উইন্ডিং এ রেটেড ভোল্টেজ এর ৩-৫% ভোল্টেজ প্রয়োগ করা হয় এবং ট্রান্সফর্মারের কারেন্ট ও ব্যবহৃত পাওয়ার পরিমাপ করা হয়। পরিমাপকৃত ডাটা হতে কপার লস এবং ইম্পিডেন্স পরিমাপ করা হয়।
  5. ইন্সুলেশুন রেজিস্ট্যান্স টেস্ট(Insulation Resistance Test): ট্রান্সফর্মারের কোর, উইন্ডিং এবং ট্যাংকের মধ্যাকার ইন্সুলেশন রেজিস্ট্যান্স পরীক্ষার জন্য এই টেস্ট করা হয়। মেগার(Megger or Mega Ohm Meter) এর মাধ্যমে ট্রান্সফর্মারের ইন্সুলেশনে উচ্চ ডিসি ভোল্টেজ প্রয়োগ করা হয় এবং ইন্সুলেসন রেজিস্ট্যান্স পরিমাপ করা হয়।
  6. ডাই-ইলেক্ট্রিক স্ট্রেস টেস্ট(Dielectric Stress Test): ওভার ভোল্টেজ প্রতিরোধে ট্রান্সফর্মারের সক্ষমতা পরীক্ষার জন্য ডাই-ইলেকট্রিক স্ট্রেস টেস্ট করা হয়। উচ্চ ভোল্টেজ প্রয়োগের মাধ্যমে এই টেস্ট করা হয়ে থাকে।
3. স্পেশাল টেস্ট(Special Test):

কোনো সুনির্দিষ্ট সমস্যা চিহ্নিত করেন বা ক্রেতার চাহিদার ভিত্তিতে টাইপ টেস্ট এবং রুটিন টেস্টের বাইরেও কিছু বিশেষ টেস্ট করা হয়ে থাকে, যেমনঃ

  1. পার্শিয়াল ডিসচার্জ টেস্ট(Partial Discharge Test): ট্রান্সফর্মারের পার্শিয়াল ডিসচার্জ পরিমাপ করার জন্য এই টেস্ট করা হয়। এই টেস্ট এর মাধ্যমে ট্রান্সফর্মারের কোনো সুনির্দিষ্ট স্থানের ইন্সুলেশনের ব্রেক-ডাউন নির্নয় করা হয়। ট্রান্সফর্মারে উচ্চ ভোল্টেজ প্রয়োগ করে বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে কাঙ্ক্ষিত স্থানের পার্শিয়াল ডিসচার্জ পরিমাপ করা হয়।
  2. লিকেজ রিয়্যাক্টেন্স টেস্ট(Leakage Reactance Test): ট্রান্সফর্মারের ভোল্টেজ রেগুলেশনে লিকেজ রিয়্যাক্টেন্স তীব্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। লিকেজ রিয়্যাক্টেন্সের মান বেশি হলে ভোল্টেজ ড্রপের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং ট্রান্সফর্মারের সরবরাহ প্রান্তে কাঙ্ক্ষিত ভোল্টেজ পাওয়া যায় না। ট্রান্সফর্মারের লিকেজ রিয়্যাক্টেন্স পরিমাপ করার জন্য এই টেস্ট করা হয়।
  3. মেকানিক্যাল স্ট্রেংথ টেস্ট(Mechanical Strength Test): এই টেস্টের মাধ্যমে ট্রান্সফর্মারের কাঠিন্য এবং বাহ্যিক আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়।
  4. টেন ডেল্টা টেস্ট(Ten Delta Test): এই টেস্টকে Dissipation Factor Test ও বলা হয়ে থাকে। আদর্শ ইন্সুলেশন অপরিবাহী এবং তা ট্রান্সফর্মারের ভিতরে ক্যাপাসিটরের ন্যায় আচরণ করে। ফলে যখন ট্রান্সফর্মারের ইন্সুলেশনের উপর ভোল্টেজ প্রয়োগ হয় তখন এর ভিতর দিয়ে রিয়্যাক্টিভ কারেন্ট প্রবাহিত হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে ইন্সুলেশন ধর্ম ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং রেজিস্টিভ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। ট্রান্সফরমারের ইন্সুলেশনে একটি লো-ফ্রিকোয়েন্সি এসি-ভোল্টেজ প্রয়োগ করে ইন্সুলেশন এর ডিজিপেশন ফ্যাক্টর পরিমাপ করা হয়। অর্থাৎ, টেন ডেল্টা টেস্টের মাধ্যমে ইন্সুলেশন কতটা রিয়্যাক্টিভ বা রেজিস্টিভ বৈশিষ্টের তা নির্নয় করা হয়।
উপসংহার(Conclusion):

ট্রান্সফর্মারের দির্ঘস্থায়িত্ত্ব, নিরাপত্তা এবং দক্ষ পরিচালনার ক্ষেত্রে নিয়মিত পরীক্ষার কোনো বিকল্প নেই। রুটিন টেস্ট উৎপাদিত প্রতিটি ট্রান্সফর্মারের গুনগত মান নিশ্চিত করে, টাইপ টেস্ট ডিজাইন অনুযায়ী উৎপাদন নিশ্চিত করে এবং স্পেশাল টেস্টের মাধ্যমে বিশেষ চাহিদা এবং বৈশিষ্ট অর্জন করা হয়। এই টেস্টগুলি করার মাধ্যমে ট্রান্সফরমারের নির্ভযোগ্য এবং নিরাপদ পরিচালন সুনিশ্চিত হয়।

Leave a Comment